ছিনতাই ও কিশোর গ্যাংয়ের প্রবণতা কমছে না রাজশাহীতে। এতে শান্তির নগরী ছিনতাইকারীদের তান্ডবে হয়ে উঠেছে অশান্ত। ছিনতাই আতঙ্কে নগরবাসী প্রতিনিয়ত চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছেন। সকালে মর্নিং ওয়ার্ক কিংবা ইভেনিং ওয়ার্কে গিয়ে পরতে হচ্ছে ছিনতাইকারীর খপ্পরে। ছিনতাইকারীদের টার্গেট হচ্ছে মূলত নারী ও শিক্ষার্থীরা। অটোরিকশা চালক, ভ্যান চালক, ব্যবসায়ীরাও পরছে এদের খপ্পরে। ছিনতাই আতঙ্কে অতিষ্ঠ রাবি ক্যাম্পাসও।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও বেড়েছে ছিনতাই প্রবণতা। দিনে দুপুরে মোবাইল, টাকা ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে রাবি শিক্ষার্থীরা। নিরাপত্তার স্বার্থে রাজশাহী মহানগরীর মোড়ে মোড়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। ২৪ ঘন্টা সিসিটিভির নজরদারিতে রাখা হয়েছে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ও সড়কগুলো। কিন্তু, এত নিরাপত্তার পরও ঠেকানো যাচ্ছে না ছিনতাই প্রবণতা। এর ফলে নগরবাসির মনে বিরাজ করছে আতংক। নগরবাসির নির্বিঘ্নে চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মূলত এই সমস্ত ছিনতাই চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে যুবক/ কিশোর গ্যাং। তারা ছিনতাই করতে ব্যবহার করছে মোটরসাইকেল। পথভ্রষ্ট মাদকাসক্ত স্কুল,কলেজের শিক্ষার্থীরা ছিনতাই চক্রের সাথে বেশি জড়িয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজশাহী মহানগরীর কিশোর গ্যাং গ্রুপ গুলো নগরীর আশেপাশের এলাকার কিশোর /যুবক গ্যাংয়ের সাথে একত্রিত হয়ে ছিনতাই কান্ড গুলো ঘটাচ্ছে।
রাজশাহীতে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতের সাথে ছিনতাইয়ের ঘটনাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। নগরীর সি এন বি মোড়, শিরইল বাস স্টান্ড, শিরইল কলোনি, খুলিপাড়া, নওদাপাড়া,বায়ার মোড়, গুড়িপাড়া, তালাইমারি শহিদমিনার, ডাব তলা,ইত্যাদি এলাকায় কিশোর গ্যাং গ্রুপ গুলো বেশ সক্রিয়। এক এলাকার গ্যাং, আরেক এলাকায় গিয়ে ছিনতাইয়ের মতো বেশিরভাগ সময়ই এদের ঘটনাস্থলে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। এদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হলেও “বড় ভাইদের” ক্ষমতাবলে এদের বেশিদিন আটক করে রাখা যায় না অথবা থানা থেকেই ছেড়ে দিতে হয়। মাঝে মাঝে কিছু চুনোপুঁটি ধরা পরলেও শক্তিশালী ছিনতাই গ্যাং গুলো ধরা ছোয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এত ব্যবস্থা ও নজরদারি বাড়ানোর পরও কমানো যাচ্ছে না ছিনতাই প্রবণতা।
গত ২২ জানুয়ারি ২০২৩ রাবি তে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে ২ জন মোটরসাইকেল ধারী ছিনতাইকারী ধৃত হয়। ৩০শে মার্চ নগরীর জিরোপয়েন্ট এলাকার একটি প্রাইভেট ব্যাংক থেকে ২.৫লক্ষ টাকা ব্যাগে নিয়ে যাওয়ার সময় স্যান্ডেল পট্টির কাছে মোটর সাইকেল করে ছিনতাইকারীরা ব্যাগটি ছিনিয়ে নেয় । গত ৯ মার্চ,২০২৩ দৈনিক কালের কণ্ঠের রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক ও রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ও কন্যা ছিনতাই চক্রের শিকার হন। ৬ এপ্রিল ২০২৩, রাজশাহীর মোহনপুর ও বাগমারা উপজেলার সীমান্ত এলাকার ধাবিন নওগাঁ বিলের মাঝখানের রাস্তায় ৫জন যুবক এক ব্যক্তির মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ৬ লক্ষ টাকা ছিনতাই করেন।২৯শে এপ্রিল,২০২৩ রাজশাহীতে র্যাব পরিচয় দিয়ে তল্লাশীর বামে ছিনতাইয়ের সময় মোস্তফা কামাল নামক একজন ছিনতাইকারী আটক হয়। ২১ মে, ২০২৩ রাজশাহীর পূঠিয়া এলাকায় ব্যাটারি চালিত ভ্যান ছিনতাইয়ের জন্য ভ্যান চালক কুদ্দুস আলীর হাত পা কেটে হত্যা করে ভ্যান ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী।মূলত বেকারত্ব সমস্যা, মাদকের টাকার জোগান দেয়ার জন্য কিশোররা ছিনতাইয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। ছিনতাই করতে গিয়ে খুন পর্যন্ত করছে। চলমান ছিনতাই প্রবণতা ও কিশোর গ্যাং তান্ডব নিয়ে প্রফেসর ড: মো: মাসুদুল হাসান(মুক্তা), প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, “পরিবার গুলো কে তাদের সন্তানদের ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে।” তিনি আরও বলেন,” দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির অভাবে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। অপরাধী কে তাদের অপরাধের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে হবে। এক্ষেত্রে অপরাধির ব্যক্তিগত পরিচয়,পদবি,দলমত ব্যতিরেকে আইনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করলে অপরাধ কমানো সম্ভব হবে।”
রাজশাহী নগর রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, আইন শৃঙখলা বাহিনী একসময় ছিল অনেক তৎপর, কিন্তু বর্তমানে রাজশাহীর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বেশ দূর্বল হয়ে গেছে। এতে কিশোর গ্যাং-ছিনতাই-মাদক প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে। এটা যদি শক্ত হাতে রাজশাহীর আইনশৃংখলা বাহিনী যদি ব্যবস্থা না নেয় তবে আগামীতে শিক্ষা নগরীতে তা ভয়াবহ রূপ নিবে। সুতরাং, আমি মনে করি যে, প্রশাসনের দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে শান্তি ও শিক্ষা নগরীর মানুষ আরও ভয়াবহ অবস্থার শিকার হতে পারে।” তিনি আরও বলেন,রাজশাহীর চলমান পরিস্থিতি কিশোর গ্যাং,মাদক,ছিনতাই নিয়ে উনার সংগঠন দ্রুত কঠোর আন্দোলনে নামবেন।
এবিষয়ে, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন রাজশাহী মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী সিনিয়র আইনজীবী আবু মোত্তালেব বাদল বলেন,” শহর উন্নতি হয়েছে, রাস্তা প্রশস্ত হয়েছে। কিন্তু পাড়া মহল্লায় পুলিশের টহল বৃদ্ধি পায়নি।” তিনি মনে করেন চিহ্নিত পাড়া মহল্লায় পুলিশের আরও সজাগ দৃষ্টি ও নজরদারি বৃদ্ধি না পাওয়ায় করলে কিশোর গ্যাং অপরাধ ও ছিনতাই প্রবণতা বেড়েছে।”
সাম্প্রতিক সময়ে শান্ত শহর রাজশাহীতে এমন ছিনতাই প্রবণতায় সাধারণ মানুষ আতংকিত হয়ে পড়েছে। কঠোর হস্তে কিশোর গ্যাং দমন ও পাড়া মহল্লায় পুলিশি নজরদারি বৃদ্ধি, মাদক বিরোধী অভিযান বৃদ্ধি, ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে ছিনতাই ও কিশোর গ্যাং তৎপরতা কমানো যাবে বলে অনেকের ধারণা।
বিএ/