স্বামীর টাকা যখন গলার কাঁটা স্বামীর অবৈধ সম্পদ ভোগ করে হাজারো নারী বিপদে ৬ বছরে দুদকের মামলায় আসামি এক হাজারের বেশি চলতি বছর আরো আড়াইশ’ আসামি হওয়ার অপেক্ষায় ইমরান আলী পিরোজপুর ১ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল আওয়ালের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের মার্চে অবৈধ সম্পদেও বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
তদন্তে আব্দুল আওয়ালের বিরুদ্ধে ৪৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পায় দুদক। এর মধ্যে তার স্ত্রীর নামে ১১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্যও আসে। সম্পদের উৎসের বৈধ কোন উৎস্য দেখাতে না পারার কারণে মামলাও দায়ের করা হয়। আব্দুল আওয়ালের পাশাপাশি এই মামলায় আসামি করা হয় তার স্ত্রী লায়লা বেগমকেও। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে আব্দুল আওয়ালের এ সম্পদ ক্রোক করে দুদক। কক্সবাজারের টেকনাফের আলোচিত ওসি প্রদিপ ঘুষের টাকায় কোটি পতি বনে গেছিলেন তার স্ত্রী চুমকি। শেষ পর্যন্ত পার পাননি। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় চুমকি এখন ফেরারী। শুধু এ দু’জনেই নয়, স্বামীর অর্জিত অবৈধ সম্পদ ভোগ করে বিপদে পড়েছেন হাজারো নারী।
সম্পদের বৈধ উৎস দেখাতে না পারায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় তারা আসামিও হয়েছেন। গত ছয় বছর অর্থাৎ ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৮৪৮টি দায়ের করা মামলায় আসামি হয়েছেন ১ হাজার ১২০ নারী। চলতি বছর অনুসন্ধান শেষে আরো প্রায় আড়াইশ’ নারী মামলার আসামি হওয়ার অপেক্ষায়। দুদক বলছে, সম্পদের বৈধ উৎস দেখাতে না পারলে আইনীভাবে তাদের সুরক্ষা দেয়ার কোন সুযোগ নাই। তাই তাদেরও আসামি করা হয়েছে। মামলায় অনেক নারী এখন জেলহাজতেও রয়েছে। দুদক
অবশ্য বলছে, প্রতিটি স্ত্রীরই জানা উচিৎ স্বামীর এ সম্পদগুলো বৈধ না অবৈধ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ সকল মামলায় স্ত্রী স্বামীরা হলেন, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, আমলা, সরকারী কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যাংক পরিচালকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। তারা তাদের স্ত্রীর নামে বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট এবং বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা রাখেন অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীরা। আর এ সকল সম্পদই এক সময় কাল হয়ে যায়। স্বামীর অর্জিত অবৈধ সম্পদের অংশীদার হয়ে তারাও মামলায় আসামি হচ্ছেন এবং জেল জরিমানার সন্মুখিন হচ্ছেন।
সম্প্রতি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়ের করে দুদক। এর মধ্যে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের বিক্রয় সহকারী সৈয়দ আয়েজ উদ্দিন আহাম্মদ ও তার স্ত্রী শাহানা বিলকিসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। খুলনার বটিয়াঘাটা থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আবু বকর সিদ্দিক ও তার স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া পারুলের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত কোটি টাকার সম্পদ আয়ের প্রমাণ পেয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক সহকারী হারবার মাস্টার আমান উল্লাহ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বেসিক
ব্যাংকের সাবেক ডিজিএম এবং ব্রাঞ্চ ইনচার্জ (চাকরিচ্যুত) সিপার আহমেদের ঘুষ-দুর্নীতির অবৈধ টাকায় কোটিপতি হয়েছেন তার স্ত্রী হাবিবা কুমকুম আহমেদ রত্মা। কোটি টাকার ফ্ল্যাট কিনেছেন স্বামীর অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে। সম্প্রতি আদালতে এই দম্পতির বিরুদ্ধে দেওয়া চার্জশিটে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন আদালতে এ চার্জশিট দেন। ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কে. এম. ইমরুল কায়েশ এ চার্জশিট দেখেছেন। চার্জশিটে বলা হয়, আসামি রত্নার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মোট মূল্য তিন কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার ২১১ টাকা।
এরমধ্যে তার মালিকানাধীন বনানীর দুই কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট ছাড়া বাকি সম্পদের মূল্য এক কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার ২১১ টাকা। রত্না বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে কাজ করাসহ কিছু ব্যবসা ও ঋণের কথা উল্লেখ করেছেন, যার একটি বড় অংশ তিনি আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন। ওই আয়গুলো বৈধ ধরে নেওয়া হলেও বনানী আবাসিক এলাকায় ১৯২০ বর্গফুট বিশিষ্ট ফ্ল্যাটটি (মৌজা-লাল সরাই, ব্লক-এফ, রোড নং-৪, বাড়ি নং-৩৭) তিনি দুই কোটি টাকা মূল্যে কিনেছেন। কিন্তু বনানীর দুই কোটি টাকা মূল্যের ওই ফ্ল্যাটটি রত্নার স্বামী সিপার আহমেদ অবৈধভাবে কিনেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে সিপার অবৈধভাবে ওই অর্থ উপার্জন করেন। চার্জশিটে আরও বলা হয়, দি প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের
গুলশান শাখার গ্রাহক সাবিক এন্টারপ্রাইজ (হিসাব নং-১০২-১৩১-১৬৩-৬)। এই হিসাবটি খোলা হয় ২০০৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেসময় প্রিমিয়ার ব্যাংকের ওই শাখায় কর্মরত ছিলেন সিপার আহমেদ। তিনিই হিসাবটির অনুমোদনকারী কর্মকর্তা। আর সিপার আহমেদের ছোট ভাই শাকিল আহমেদ ওই হিসাব পরিচালনাকারী। সাবিক এন্টারপ্রাইজ নাম শুনলেই মনে হবে যে এটি একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। অথচ হিসাব খোলার ফর্মে অর্থের উৎসের ঘরে কিছুই লেখা নেই। হিসাব খোলার পর থেকে ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবটিতে সর্বোচ্চ স্থিতি ছিল ১০ লাখ ৪৫ হাজার ৪৪০ টাকা। যা হিসাব খোলার দুদিন পর আট লাখ ৫০ হাজার টাকা নগদ জমার কারণে হয়েছিল। অথচ বেসিক ব্যাংকের চারটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা
জমা হওয়ায় অল্প কয়েক দিনেই হিসাবটির চেহারা পাল্টে যায়। ২০১১ সালের ১২, ১৪, ১৯ ও ২১ সেপ্টেম্বর পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই হিসাবে যথাক্রমে ৬০ লাখ, ৫০ লাখ, ৩২ লাখ ও ৮০ লাখ টাকা জমা হয়। ৫ দিনের ব্যবধানে তিন কিস্তিতে দুই কোটি টাকা বনানীর ফ্ল্যাট বাবদ এশিউর প্রপার্টিজ লিমিটেডকে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এত বড় অংকের লেনদেন ওই হিসাবটিতে আর কখনই দেখা যায়নি। বেসিক ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আবেদনকারীর নাম-পরিচয় গোপন করে ইস্যুকৃত এসব পে-অর্ডারের সবগুলোতেই সিপার আহমেদের হাতের লেখা। যা খালি চোখে বুঝাই যায় না। কিন্তু নগদ টাকা
কোথায় থেকে এসেছে এবং প্রকৃত জমাদানকারীর পরিচয় আবেদন দেখে বুঝা কষ্ঠসাধ্য। ওই সময় সিপার বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখার ম্যানেজার ছিলেন। ওই ঋণ হিসাবগুলো বর্তমানে শ্রেণিকৃত এবং এদের সবার বিরুদ্ধেই দুদক মামলা করেছে যা তদন্তাধীন রয়েছে। সিপার আহমেদকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি কোনো সদুত্তোর দিতে পারেননি। এসব অর্থের বৈধ কোনো উৎেসর সন্ধানও তিনি দিতে পারেননি। সুতরাং রত্নার মালিকানাধীন ফ্ল্যাটটি জ্ঞাত আয় বহির্ভূত দুই কোটি টাকা দিয়ে কিনে তিনি ভোগ দখলে রেখেছেন। তার স্বামী সিপার আহমেদ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে রত্নাকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন।
স্বামীর অবৈধ সম্পদ রত্না তার নিজ নামে রেখেছেন। চার্জশিটে ৩৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ১৭ জুলাই শুধুমাত্র সিপারের স্ত্রী রত্নার বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। দুদকের উপ-পরিচালক জি এম আহসানুল কবীর বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা মডেল থানায় মামলাটি করেন। মামলায় সিপারকে আসামি করা না হলেও চার্জশিটে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এক কোটি ৪০ লাখ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ মামলাটি করা হয়। চার্জশিটে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। নাম প্রকাশ না করা শর্তে দুদকের মামলার আসামি এক সরকারী কর্মকর্তার স্ত্রী বলেন, এটি খুবই দুঃখজনক।
দুদক মামলা দায়ের করেছে পাশাপাশি তদন্ত করছে। আমি আগে জানলে এ রকম হতো না। আসলে আমার স্বামীর নিকট কোন কিছু চাওয়ার আগেই দিয়ে দিত। বর্তমানে আমি খুবই অনুতপ্ত। দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, অনেক স্ত্রীরাই এ টাকার সম্পর্কে কোন খোঁজ রাখেন না। আবার অনেক সময় স্বামীকে বাঁচাতে তারা নিজেদের অ্যাকাউন্টেও টাকা রাখেন। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে মেয়েরা যদি সচেতন হয় তাহলে তারা এ মামলা মোকদ্দমায় জড়াবেনা। দূর্নীতিবাজ স্বামীকে বাঁচাতে যে নারীরা এগিয়ে আসেন তারাই আসলে মামলার আসামি হচ্ছেন। তবে মামলা থেকে বাঁচতে দুর্নীতিবাজ পুরুসের স্ত্রীদের আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বিএ