সন্তান হত্যার বিচার না পেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক নিহত সাফায়েত মাহবুব ফারাইজির মা ও মামলার বাদী শামীমুন নাহার লিপি। একদিকে ছেলে হারানোর শোক, অন্যদিকে এই মামলায় অভিযুক্তদের পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনায় তিনি মূর্ছরে পড়েছেন। শোকে লিপি নিজের বাড়িতে ভূতুড়ে পরিবেশে একাকি জীবনযাপন করছেন।
নিহত ফারাইজির মা শামীমুন নাহার লিপি অভিযোগ করেন, আসামিরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। পরিকল্পিতভাবে হত্যার আলামত নষ্ট করেছে। এমনকি হত্যার ৪৫ দিনেও থানায় মামলা নেয়নি। পরবর্তীতে মার্কিন দূতাবাসের পরামর্শে আমি আদালতে মামলা করি। মামলার প্রধান আসামি সুজানার সঙ্গে বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার তয়াছের জাহান ও উপপরিদর্শক (এসআই) মশিউর সম্পৃক্ত ছিল। পরে আদালত মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয় পিবিআইকে। কিন্তু সেই তদন্তেও পুলিশ কর্মকর্তা তয়াছের প্রভাব বিস্তার করায় চূড়ান্ত অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়েছে। তয়াছের জাহান আমার সন্তানকে বেওয়ারিশ হিসাবে গুম করতে চেয়েছিল। তাই থানায় যাওয়ার পর তার নির্দেশে পুলিশের অন্য সদস্যরা আমাকে কোনো তথ্য দেয়নি। এমনকি আমার সন্তানের মৃত্যুর খবরে আমি থানায় কান্না করায় আমার সঙ্গে সে খারাপ ব্যবহার করে। তার কারণে ওই সময় থানার ওসিও খুনের মামলা নেয়নি।
শামীমুন নাহার লিপি আরো অভিযোগ করেন, এসি তয়াছের জাহান বাবু ও এসআই মশিউর মামলা যেন না করা হয়, সেজন্য আমাকে হুমকি দিয়েছে। আমাকে
দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল। এমনকি, মামলার ১ নম্বর আসামি সুজানাকে অন্যত্র পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। সর্বশেষে মামলার তদন্তেও নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে এসি তয়াছের জাহান। প্রভাব খাটিয়ে অভিযোগে উল্লেখিত আসামির তালিকা থেকে সুজানা ছাড়া অন্য সবার নাম বাদ দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি হয়েছে যেন অভিযুক্ত তয়াছের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলে তার সাত খুন মাফ হয়ে যাবে! আমার ছেলের বিচারের আশা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। গত বছর ৯ জানুয়ারি ডিএমপি কমিশনারের কাছে হত্যার বিচার চেয়ে আবেদন করলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
তিনি জানান, সাফায়েত মাহাবুব ফারাইজি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন। তিনি নিজের জন্মদিন উপলক্ষে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে আসেন। তার বন্ধু সুজানা তাবাসসুম সালাম, মো. আফতাব, মো. শাখাওয়াত ও আসওয়াদসহ কয়েকজন প্রায়ই বাসায় আসত। মাদকাসক্ত সুজানার সঙ্গে ফারাইজির চলাফেরা বন্ধ করে দেয়ার কারণে তারা ক্ষিপ্ত হয়। ২৩ নভেম্বর সুজানা, আফতাব, শাখাওয়াত ও আসওয়াদ বাসায় এসে মা ছেলেকে মারধর করে। তখন লিপি ৯৯৯ কল দিলে রামপুরা থানা থেকে পুলিশ এসে বিষয়টি মীমাংসা করে।
এরপর ফারাইজি তার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ১০ ডিসেম্বর ফারাইজির ওপর আবারো হামলা করে। ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের অনুষ্ঠানের জন্য সুজানা ও অন্যরা বাসায় এসে ফারাইজিকে নিয়ে যায়। এরপর আর বাসায় ফেরেনি। ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভাটারার একটি বাসা থেকে ফারাইজির লাশ উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, দিনের পর দিন থানায় ঘুরেও ছেলের হত্যার মামলা করতে পারিনি। ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলা হয়। মামলায় ডিএমপির বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) তয়াছের জাহানসহ আটজনকে আসামি করা হয়। অন্য আসামিরা হলো- ভাটারা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মশিউর রহমান, ফারাইজির বান্ধবী সুজানা তাবাসসুম সালাম, তার সহযোগী আফতাব, শাখাওয়াত, আসওয়াদ, বাড়ির মালিক কামরুল হক ও বাড়ির ব্যবস্থাপক রিপন।
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী সরোয়ার বলেন, আদালতের পিবিআইকে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিল। পিবিআই তদন্ত শেষে সুজানা তাবাসসুম সালামকে দোষী সাবস্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করে। অন্য আসামিদের অব্যাহতি দেয়া হয়।
উলেখ্য,, ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল দিয়ে লিপিকে বলা হয় ফারাইজির মৃতদেহ বাড্ডা থানায় রয়েছে। ছেলের সন্ধানে থানায় গেলে লিপিকে জানানো হয়, তাকে থানা থেকে ফোন দেয়া হয়নি। তখন তয়াছের জাহান লিপির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। ওইদিন থানায় প্রায় ১১ ঘণ্টা বসিয়ে রেখে লিপিকে দিয়ে বিভিন্ন সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেয় ভাটারা থানা পুলিশ। পরবর্তীতে জানানো হয়, ফারাইজির মরদেহ শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রয়েছে।
বিএ/