মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:০০ পূর্বাহ্ন

ভর্তুকি কমাতে পানি, বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হোন: প্রধানমন্ত্রী

অনুসন্ধান ডেস্ক
  • আপলোডের সময় : রবিবার, ৬ মার্চ, ২০২২

পানি পরিশোধন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সরকার ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী।

ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে দেশের সব নাগরিককে বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

ঢাকার কাঁচকুড়া হাই স্কুল মাঠে রোববার দুপুরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডের সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার নির্মাণ ও উন্নয়ন (ফেজ-১) প্রকল্পের উন্নয়নকাজের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, ‘এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বা এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে কিন্তু অনেক অনেক বেশি টাকা খরচ হয়। সেখানে আমরা ব্যাপক হারে ভর্তুকি দিচ্ছি, কিন্তু বিদ্যুৎ সুবিধা সবাই ভোগ করবেন। ভর্তুকি আমরা দেব কোত্থেকে? এটা তো জনগনের ট্যাক্সের টাকায় দিতে হচ্ছে।

‘কাজেই যারা ব্যবহার করবেন, উৎপাদনের খরচ তো তাদের দিতে হবে, তবেই না আপনি সুবিধাটা ভোগ করতে পারবেন। তারপরেও যাতে মানুষের জীবনমান উন্নত হয়, সে জন্য ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি। এখানে আমার অনুরোধ থাকবে, বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধ করতে হবে; বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে।’

পানিরও ক্ষেত্রেও একই চিত্র বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আজকে বিভিন্ন নদী থেকে পানি এনে সেটাকে পরিশুদ্ধ করতে অনেক অনেক টাকা খরচ হয়। সেটা হয়তো আপনারা চিন্তাও করতে পারবেন না, কত বেশি টাকা খরচ হয়। সেই পানি ব্যবহারেও প্রত্যেকটা নাগরিককে সাশ্রয়ী হতে হবে; অপচয় বন্ধ করতে হবে।’

আক্ষেপের সুরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যে পানি পরিশুদ্ধ করে দিই, সেটা দিয়ে সব কাজ চলে। গাড়ি ধোয়া থেকে শুরু করে কনস্ট্রাকশনের কাজ থেকে শুরু করে সবই করে, কিন্তু এই পানি পরিশুদ্ধ করতে কত টাকা খরচ হয়, সেই হিসাব আপনারা জেনে নেবেন এবং সেই মোতাবেকৃসেখানেও আমাকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সেখানে কিন্তু ভর্তুকি দেয়া ঠিক না।’সবার সাশ্রয়ী ব্যবহার করলেও বিল যেমন কম আসবে, ভর্তুকির পরিমাণও কমবে বলে মনে করেন সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকে বিল কমাতে পারেন, বিদ্যুৎ বিল কমাতে পারেন, পানির বিল কমাতে পারেন, গ্যাসের বিল কমাতে পারেন, যদি আপনি একটু সচেতন হোন, সাশ্রয়ী হোন।’

‘খাল এজমালি সম্পত্তি নয়’

ঢাকা শহরকে বাঁচিয়ে রাখতে বেদখল হওয়ার খালগুলো উদ্ধারে আবারও তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, ‘মানুষের শরীরে শিরা, উপশিরায় যেমন রক্ত সঞ্চালন হয়, একটা শহরের জন্য এই খালগুলো কিন্তু সেই পানি সরবরাহের মাধ্যমে শহরগুলোর বেঁচে থাকার সঞ্চালন হয়। সেটা উদ্ধার করা একান্তভাবে অপরিহার্য।’

দখলদারদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আর অনেক খাল তো বেদখল হয়ে যায়, খালটা তো মনে হয় এজমালি সম্পত্তি, যে যেভাবে পারে ঘরবাড়ি তৈরি করে দখল করে নেয়, দোকানপাট তৈরি করে ফেলে। সেটা উদ্ধার করার জন্য যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সে জন্য আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

বক্স কালভার্ট নির্মাণ ‘খারাপ কাজ’ ছিল বলেও মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘যেখানে মুক্ত খাল ছিল, এই খালটা রেখে দুপাশে রাস্তা করা যেত বা পিলার দিয়ে তার ওপর দিয়ে এলিভেটেড রাস্তা করা যেত, কিন্তু বক্স কালভার্ট করার ফলে জলাবদ্ধতা হয়, আবার সেখানে ময়লাও জমে, আবার নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়।

গুলশানে হবে খেলার মাঠ

ঢাকার গুলশানে নতুন একটি খেলার মাঠ হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, ‘১০ বিঘা একটা জমি। ওখানে ইতালিয়ান অ্যাম্বাসির একটা ইৃছিল, আরেকটি অ্যম্বাসির ছিল, তারা ওখান থেকে সরে যাচ্ছে। বিজিএমসির একটা বাসা ছিল। সেটাও আমি সরিয়ে দিচ্ছি। এই জায়গাটা সম্পূর্ণ খেলার মাঠ হবে। সেখানে আর কোনো স্থাপনা না, কিচ্ছু না, শুধু মাঠ।’

‘গুলশানের দুই বাড়ির মাঝে ময়লার ডিপো’

গুলশানের আবাসিক ভবন নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘গুলশানের যে ফ্ল্যাট-বাড়িগুলো সেগুলো নিয়ে আমার কিছু কমপ্লেইন আছে। কারণ কেউই এক ইঞ্চি জায়গা ঠিকমতো ছাড়েননি। দুটো বাড়ির মাঝে এমন চাপা জায়গা। আর ওই জায়গাগুলোতে ময়লার ডিপো হয়ে থাকে।’

সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমি তো সবসময় বের হই না, দেখতে পাই না। কিন্তু যখন যেখানে যাই, একটু দেখার চেষ্টা করি।’

সাবেক মেয়র আনিসুল হককে বিষয়টি জানানো হলে তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এটা আমি বর্তমান মেয়রকেও বলব, আপনি যদি একটু লক্ষ করেন, দুটি মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিং হচ্ছে, দুটি বাড়ির ভেতরে হাই-ফাই জীবনযাপন, বিশাল ঝাড়বাতি মাথায় ঠেকে, কিন্তু দুই বাড়ির মাঝখানে গেলে দেখবেন ময়লার ডিপো। এটা যেন না থাকে।’

মানতে হবে ট্রাফিক আইন

রাস্তা পারাপারে ট্রাফিক আইন ও নিয়ম মেনে চলার অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যেখান-সেখান থেকে দৌড় মেরে রাস্তা পার হতে যেয়ে অ্যাক্সিডেন্ট হলে তো ড্রাইভার মার খায়। তো এটা কি ড্রাইভারের একার দোষ? অথচ আমি যদি ঠিক পথে না চলি, নিয়ম মেনে না চলি, ট্রাফিক আইন না মেনে চলি, তাহলে তো অ্যাক্সিডেন্ট হবেই।’

সড়কে বেড়া দেয়া হলে সেটি টপকে রাস্তা পার হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে বলেও জানান শেখ হাসিনা।

নগরে বাড়াতে হবে সবুজ

বহুতল ভবনের কারণে ঢাকা শহরের গাছের সংখ্যা ও সবুজের পরিমাণ কমে গেছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। আর তাই ছোট পরিসরে হলেও সবুজ বাড়াতে নগরবাসীকে উদ্যোগী হতে বলেছেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার অনুরোধ থাকবে, যার যেখানে যতটুকু জায়গা আছে, যেভাবে পারেন, আপনারা একটু বৃক্ষরোপণ করুন; ছাদবাগান করবেন। যেভাবে পারেন একটু কিছু করেন, যাতে প্রচুর সবুজ থাকে। আর পরিবেশটা যেন ঠিক থাকে, সে বিষয় বিশেষভাবে নজর দেবেন।’

বিহারিদের উন্নয়ন নিয়ে ভাবছে সরকার

পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও আটকে পড়া পাকিস্তানিদের নেয়নি দেশটির সরকার। মানুষ হিসেবে তাদের সম্মান দিতে ‘বিহারি’ নামে পরিচিত এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নেও সরকার পরিকল্পনা করছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘তারা পাকিস্তানে যাবে বলে, পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেবে বলে অপশন দিয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান কখনও তাদের গ্রহণ করেনি। তাদের নাম করে অনেক প্রতিষ্ঠান অনেক টাকা-পয়সাও তুলেছে, অনেক কিছু করেছে, কিন্তু তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি।

‘এখন বলতে গেলে তাদের ছেলে-মেয়ে হয়ে গেছে, নাতি-পুতি হয়ে গেছে। তাদের বংশ পরম্পরা বেড়ে গেছে, কিন্তু ওই যে জেনেভা ক্যাম্পের ছোট্ট ছোট্ট জায়গা, সে জায়গায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করে।’

কাজে তারা ‘খুব কর্মঠ’ ও ‘দক্ষ’ দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ কারণে আমি চাচ্ছি যে, তাদের জন্য একটা ভালো বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া, তারা যে যে কাজে পারদর্শী, সে কাজে যেন তারা নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারে, জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারে। সে ব্যবস্থাটা আমাদের করতে হবে।’

ঢাকায় সেটা করা কঠিন বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যেখানে ইন্ডাস্ট্রি আছে বা কাজ আছে, যেখানে তাদের কাজ করার সুযোগ আছে। সে ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের জন্য করতে হবে। তাহলে তারা অন্তত ভালোভাবে মানুষের মতন বাঁচতে পারবে। সেটাই আমি চাই।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষকে মানুষ হিসেবে আমরা দেখতে চাই। তারা হয়তো এখানে থাকতে চায়নি, কিন্তু এখন যাবেই বা কোথায়? তাদের যে বংশবৃদ্ধি, তারা তো আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করেছে।’

উন্নয়নকাজের উদ্বোধন

সবার জন্য নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুইটি অংশে বিভক্ত করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে পরিণত করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি সিটি করপোরেশন দিয়ে ঢাকা শহরের এত মানুষকে সেবা দেয়া অসম্ভব ছিল। যে কারণে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকার আশপাশে ইউনিয়নগুলো যেগুলো ঢাকা শহরের সংলগ্ন অথচ তারা নাগরিক সুবিধা পাচ্ছেন না। সেই মানুষগুলোর যারা এখানকার আদি বাসিন্দা, তারাসহ অন্যদেরও একই অবস্থা; নিজেদের অবহেলিত মনে করত।

‘সে কারণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, এটিকে দুটো ভাগে ভাগ করা। বাকি যে জায়গাগুলো, সেগুলো কেউ আমরা সম্পৃক্ত করে ফেলব দক্ষিণ এবং উত্তরে। যে ইউনিয়নগুলো ছিল, সেগুলো ওয়ার্ডে ভাগ করে সিটি করপোরেশনের সমস্ত নাগরিক সুবিধা যাতে পায়, সে ব্যবস্থাটা আমরা নিয়েছি।’

পরে ঢাকা উত্তর সিটির উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত হরিরামপুর ইউনিয়ন এবং পূর্বাঞ্চলে উত্তরখান, দক্ষিণখান, বাড্ডা, বেরাইদ, ডুমনি, সাঁতারকুল ও ভাটারা ইউনিয়নের এলাকাগুলোর ১৮টি ওয়ার্ডকে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালের ৯ মে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে আটটি করে ইউনিয়ন যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।

১৮ ওয়ার্ডের উন্নয়নকাজের উদ্বোধন

এ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের যে ইউনিয়নগুলো ছিল, সেগুলোকে ওয়ার্ডে উন্নীত করার পর সেখানকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা, সেটা একান্তভাবে অপরিহার্য ছিল। আজকের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমি মনে করি যে, এখানে যে মানুষগুলো বসবাস করে, তারা সুন্দর, চমৎকার একটা জীবন পাবেন। এবং নাগরিক সুবিধাগুলি তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে।’

প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর ওপর দেয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দেখেছি, যত কঠিন কাজ হয়, তাদেরকে দায়িত্ব দিলে অত্যন্ত সুচারুভাবে, তারা সেটা পালন করে এবং বাস্তবায়ন করে।’

স্থানীয় জনগণকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সহযোগিতা করতে হবে বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘তাদের পাশে থেকে কাজ করতে হবে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে কাজটা সুন্দর, সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।’

জনভোগান্তির বিষয়টি সামনে এনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে মানুষের যাতে অসুবিধা না হয়, সেটাও দেখতে হবে। সেই সঙ্গে আরেকটি বিষয় বলব যে, মানুষের যেমন সুবিধা ভোগ করার অধিকার আছে, আবার নাগরিক কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। যারা অধিকার ভোগ করবে, তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।

‘সেই ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই নিজ নিজ ঘরবাড়ি শুধু না, নিজের সামনের রাস্তাটাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। এই পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে হাসতে হাসতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মেয়র সাহেব মশা মারার কাজ করতে গিয়ে, পরিছন্নতা কাজ দেখতে গিয়ে কিন্তু পা পিছলে একবার পা ভেঙে ফেলেছিলেন। ভবিষ্যতে যেন এই ঘটনা আর না ঘটে আমি আশা করি, সেদিকে দৃষ্টি দেবেন।’

বিএ

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর..