অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ‘জনবান্ধব পুলিশ’ গঠন করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে । দেশের সব থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে এরই মধ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। তবে ৫ আগষ্ট- পূর্ববর্তী সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ও পররবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের কারণে সাধারণ জনগণের সাথে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের দূরত্ব বেড়েছে। সাধারণ মানুষের মনে পুলিশ বাহিনীর প্রতি আস্থার জায়গাতেও ধরেছে ফাটল। বিগত ১৫ বছর ধরে স্বৈরাচার সরকারের লেজুড়বৃত্তি এবং জুলাই-আগষ্টের ছাত্র জনতার আন্দোলনে পুলিশ বাহিনীর প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ ও আন্দোলনকারীদের উপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুন্ন হয়। এরফলে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের উপর নিপীড়িত সাধারণ মানুষের মনে জমা হয় ক্ষোভ।
গত ৫ই আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণ অভ্যূত্থানের পর জনরোষের মুখে পড়ার জন্য পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরফলে রাজারবাগে ক্ষোভের চরম বিস্ফোরণ ঘটান বাহিনীর কিছু সদস্য। এর পরবর্তী পুলিশ বাহিনী সহ দেশের বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশ বাহিনীকে দানব থেকে জনবান্ধব রূপে গড়ে তোলার জন্য দাবী উঠে। দীর্ঘ ১৫ বছর পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ন্যাক্কারজনকভাবে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল স্বৈরাচার সরকার প্রধান পলাতক শেখ হাসিনা ও তার দোসররা। এরফলে বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে ক্ষুন্ন হয়। কিন্তু, ৫ই আগষ্টের ছাত্র-জনতার গণ অভ্যূত্থানে দেশ ছেড়ে পালায় স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। সেইসাথে পালটে যায় বাংলাদেশের দৃশ্যপট। দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরাচার সরকারের হুকুমের তাবেদারি করা বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে তার হারানো মনোবল, আস্থা ফিরিয়ে দেওয়া ও পুলিশ বাহিনীকে জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে তোলার কাজ হাতে নেই অন্তর্বর্তীকালীন ড. ইউনুসের সরকার।
পুলিশের উর্ধ্বতন মহল থেকে জানানো হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে তৈরি নতুন বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ পুলিশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এছাড়া পুলিশের সেবা হয়রানিমুক্ত ও জনবান্ধব হবে বলেও জানায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে চরমভাবে কলঙ্কিত পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি শুদ্ধ করার লক্ষ্যে পুলিশ বাহিনীকে প্রকৃত অর্থে জনবান্ধব করে গড়ে তোলা ও জনগণের হয়রানিহীন নাগরিক সেবা সুনিশ্চিত করে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ইতোমধ্যে গৃহীত হয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। পুলিশ বাহিনীকে জনবান্ধব করার অংশ হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ৭.৬২ এমএম রাইফেলের ব্যবহার অর্ধেক কমিয়ে তার পরিবর্তে কম ক্ষতির ৯ এমএম এসএমজি ব্যবহারের সুপারিশ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপি মো. ময়নুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ পুলিশের অস্ত্র, গোলাবারুদ, রায়টসামগ্রীর প্রাধিকার নির্ধারণ সংক্রান্ত সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পুলিশের এ সিদ্ধান্ত পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আকারে যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এ তথ্য দিয়ে বলেছে, ৭.৬২ এমএম রাইফেলের সাহায্যে ৪০০ মিটার দূরত্বে গুলি ছুড়লেও প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু ৯ এমএম এসএমজি দিয়ে ৫০ মিটার দূরত্বে গুলি ছুড়লে প্রাণহানির কোনো আশঙ্কা থাকবে না।
পুলিশের পদস্থ একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রাণঘাতী রাইফেল ব্যবহার করতে চায় না পুলিশ। এ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের মধ্য দিয়ে জনবান্ধব পুলিশ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ অস্ত্র ব্যবহারে পুলিশ কম শক্তি প্রয়োগ করে অবৈধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হবে। প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে আনার ফলে অবৈধ জনতা নিয়ন্ত্রণে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানির ঘটনাও অনেক কমে যাবে। সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সভায় বিস্তারিত আলোচনায় বেশ কিছু বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো- অস্ত্রের প্রাধিকার থেকে রিভলবার বাদ দেওয়া হবে, ৭.৬২ এমএম পিস্তল প্রাণঘাতী হওয়ায় তার পরিবর্তে উপযুক্ত কম প্রাণঘাতী বোরের অস্ত্র প্রবর্তন, জনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় প্রাণঘাতী লিড বলযুক্ত শটগানের কার্তুজ ব্যবহার নিষিদ্ধ, এর পরিবর্তে প্রাণঘাতী নয় এমন সফট কাইনেটিক প্রজেকটাইলের প্রবর্তন, ৭.৬২ এমএম প্রাণঘাতী রাইফেলের ব্যবহার অর্ধেক কমিয়ে তার পরিবর্তে তুলনামূলক কম ক্ষতিসাধনে সক্ষম ৯ এমএম এসএমজি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব শিগগিরই অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য আইজিপি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। একটি সূত্র হতে জানা যায় ৭.৬২ এমএম রাইফেলের সাহায্যে ৪০০ মিটার দূরত্বে গুলি ছুড়লেও প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু ৯ এমএম এসএমজি দিয়ে ৫০ মিটার দূরত্বে গুলি ছুড়লে প্রাণহানির কোনো আশঙ্কা থাকবে না।এ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের মধ্য দিয়ে জনবান্ধব পুলিশ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ অস্ত্র ব্যবহারে পুলিশ কম শক্তি প্রয়োগ করে অবৈধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হবে পুলিশ।
অস্ত্রের প্রাধিকার নির্ধারণে খুলনা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের কমান্ড্যান্ট ডিআইজি আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরীকে সভাপতি করে একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটি ৪টি সভা ও পুলিশের সব বিশেষায়িত ইউনিট যেমন- এন্টি টেরোরিজম ইউনিট, এপিবিএন, এসপিবিএন, র্যাব, হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ-পুলিশ, ডিএমপি, ঢাকা রেঞ্জ, চট্টগ্রাম রেঞ্জ, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, সিআইডি, এসবি, পিবিআইয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করে। গত বৃহস্পতিবার (১৭ই অক্টোবর) পুলিশ হেডকোয়ার্টারে এই সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ট্রেনিং সেন্টারের কমান্ডেন ডিআইজি আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী।
উক্ত সভাসমূহ ও ওয়ার্কশপের সিদ্ধান্তের আলোকে অস্ত্রের প্রাধিকারের খসড়া প্রস্তুত করা হয়। এর পাশাপাশি কমিটি অস্ত্রের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের উপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল এই বিষয়ে একমত পোষণ করে একটি ট্রেনিং মডিউল প্রস্তুত করে সকল পুলিশ ইউনটে প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত চর্চার নির্দেশ দেন।
পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের ঊর্ধতন কর্মকর্তাগণ ছাড়াও ঢাকাস্থ সকল পুলিশ ইউনিটের ডিআইজি পদমর্যাদার প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, অস্ত্রের এই প্রাধিকার অনুমোদিত হলে পুলিশ কমশক্তি প্রয়োগ করে অবৈধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হবে। প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে আনার ফলে অবৈধজনতা নিয়ন্ত্রণে অনাকাংখিত প্রাণহানির ঘটনাও অনেক কমে যাবে।
এসব সভায় ও ওয়ার্কশপের সিদ্ধান্তের আলোকে অস্ত্রের প্রাধিকারের খসড়া প্রস্তুত করা হয়। এর পাশাপাশি কমিটি অস্ত্রের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। আইজিপি এ বিষয়ে একমত হয়ে একটি ট্রেনিং মডিউল প্রস্তুত করে সব পুলিশ ইউনিটে প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত চর্চার নির্দেশ দেন।
বিএ..