সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৭ অপরাহ্ন

খাবার পানির জন্য হাঁটতে হয় দুই কিলোমিটার

অনুসন্ধান ডেস্ক
  • আপলোডের সময় : মঙ্গলবার, ২২ মার্চ, ২০২২

চল্লিশ বছর বয়সী চঞ্চলা মুণ্ডা স্বামী-সন্তান নিয়ে বাসবাস করেন খুলনার কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা গ্রামে। তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী। ওই নদীর অন্য পাড়ে সুন্দরবন। চঞ্চলা মুণ্ডা প্রতিদিন বিকেলে খাবার পানি আনতে যেতে হয় পাশের গ্রাম ৫ নম্বর কয়রায়।

তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটি পুকুর আছে। প্রায় ৫০ মিনিট হেঁটে গিয়ে আমি সেখানে থেকে পানি আনি।
‘প্রতিদিন আমাদের পরিবারের সদস্যদের খাওয়ার জন্য প্রায় ২০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। একটি কলসি নিয়ে আমাকে সেই পরিমাণ পানি আনতে হয়।’

সম্প্রতি ওই গ্রাম পরিদর্শন করেছেন । গ্রামের প্রায় সব পরিবারের নারীদের পানি আনতে পাশের গ্রামে যেতে দেখা গেছে।

উপকূলবর্তী কয়রা উপজেলার সব গ্রামেই কমবেশি সুপেয় পানির সমস্যা। স্থানীয় সুন্দরবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল আলম বলেন, ‘কয়রা সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামেই শুধু টিউবওয়েল থেকে খাওয়ার পানি পাওয়া যায়। মহেশ্বরীপুর, আমাদী, বাগালী, মহারাজপুর, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে খাওয়ার পানির কোনো ব্যবস্থা নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের উপজেলায় পানি সংকট সমাধানে বিভিন্ন সময় নানা রকমের প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেগুলো টেকসই হয়নি। অনেক সময় পুকুর খনন করা হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে লবণ পানিতে সেগুলো তলিয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে সেগুলো থেকে খাবার পানি পাওয়া যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘কয়রার অধিকাংশ গ্রামে টিউবওয়েল থেকে মিষ্টি পানি পাওয়া যায় না। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়। তাই বেশি বেশি করে এখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধান হতে পারে।’খুলনার আরেকটি উপকূলীয় উপজেলা দাকোপেও সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন

এ উপজেলার কালাবগী, সুতারখালী, কামারখোলা ও গুনারী এলাকায় পানির তীব্র সংকট।কালাবগী গ্রামের আছাদুল বলেন, ‘আমাদের পরিবারের জন্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরের একটি পুকুর থেকে পানি নিয়ে আসি। প্রতি সপ্তাহে নৌকায় করে বেশ কয়েকটি ড্রাম ও কলসিতে করে পানি আনি। সেই পানিতে ফিটকিরি দিয়ে পান করি।’

ওই গ্রামের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক মানবেন্দ্র রায় বলেন, ‘খাওয়ার জন্য পুকুরের পানিই আমাদের একমাত্র ভরসা। আমি নিজে গিয়ে পানি আনতে পারি না। তাই প্রতি ৩০ লিটার পানি ৫০ টাকা দরে কিনে খাই। একজন ভ্যানওয়ালা তিন কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে এ পানি এনে আমার কাছে বিক্রি করে।’

তিনি বলেন, ‘লবণাক্ত পানিতে গোসল করতে হয় বলে আমার খুলনায় পড়া মেয়ে গ্রামে আসতে চায় না।’

এ ছাড়া উপকূলীয় পাইকগাছা উপজেলাতেও সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। সেখানের লতা, দেলুটি, সোনাদানা ও লস্কর ইউনিয়নে পানির সংকট সব থেকে বেশি।

খুলনা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এই তিন উপজেলার বেশির ভাগ এলাকায় নলকূপ বসানো সম্ভব নয়। ফলে সেখানকার খাবার পানির মূল উৎস পুকুর, জলাশয় ও বৃষ্টির পানি।

২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপে দেশের উপকূলীয় মানুষের নিরাপদ খাবার পানির দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর– এই পাঁচ উপকূলীয় উপজেলার ৭৩ শতাংশ মানুষকে অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করতে হচ্ছে।

ওই জরিপে দেখা গেছে, উপকূলীয় ৫ উপজেলার মানুষের প্রতি লিটার খাবার পানিতে ১ হাজার ৪২৭ মিলিগ্রাম থেকে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা রয়েছে। তবে পানির প্রতি লিটারে ১০০০ মিলিগ্রামের বেশি লবণাক্ততা থাকলে তা খাওয়ার অনুপযোগী বলে জরিপে বলা হয়েছে।

এলাকাবাসী পানি সংগ্রহ করে এ রকম ৫২ শতাংশ পুকুর ও ৭৭ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় লবণাক্ততা পাওয়া গেছে।

গড়ে দাকোপ উপজেলার পুকুরগুলোতে ৬৫০ মিলিগ্রাম, কয়রায় ১ হাজার ২৪ মিলিগ্রাম, পাইকগাছায় ১ হাজার ৫৮১ মিলিগ্রাম, আশাশুনিতে ১ হাজার ২০৩ মিলিগ্রাম এবং শ্যামনগরে ১ হাজার ১৮৪ মিলিগ্রাম লবণাক্ততা পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া টিউবওয়েলের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা রয়েছে দাকোপে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম, কয়রায় ১ হাজার ৪৫৩ মিলিগ্রাম, পাইকগাছায় ১ হাজার ৫১০ মিলিগ্রাম, আশাশুনিতে ৯৯৮ মিলিগ্রাম ও শ্যামনগরে ১ হাজার ৬৮৩ মিলিগ্রাম।

এ ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে বা শীতকালে শ্যামনগর উপজেলার টিউবওয়েলের প্রতি লিটার পানিতে ৬ হাজার ৬০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা পাওয়া গেছে, যা অনুমোদিত সীমার চেয়ে ছয় গুণেরও বেশি।

পাঁচটি উপকূলীয় উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়নে ৬৬ হাজার ২৩৪টি পরিবারের ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৪ জনের মধ্যে ওপর ‘জেন্ডার-রেসপন্সিভ কোস্টাল অ্যাডাপটেশন (জিসিএ)’ শীর্ষক এক জরিপ চালানো হয়।

এতে দেখা যায়, অনেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে দৈনিক দুই ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করেন। কখনও কখনও টিউবওয়েল বা পুকুর থেকে পানি আনতে তাদের এক কিলোমিটারের বেশি হাঁটতে হয়। আর ১৬ শতাংশেরও বেশি পরিবারের লোকেরা বলেছেন, তাদের আরও বেশি হাঁটতে হয়।

জরিপে আরও দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ মানুষ সেই পানি পেতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। কারণ তাদের খাবার পানির অন্য কোনো উৎস নেই।

এ ছাড়া ৭৪ শতাংশ পরিবারের নারীরা এবং ১০ শতাংশ পরিবারের পুরুষরা পানি সংগ্রহ করে। বাকি পরিবারের পুরুষ ও মহিলা ভাগাভাগি করে পানি সংগ্রহ করে।গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এই জরিপ প্রকল্পের সমন্বয়কারী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘উপকূলীয় এই পাঁচ উপজেলায় বসবাসকারীদের খাবার পানি সংগ্রহ করতে রাজধানীবাসীর চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘প্রায় তিন দশক ধরে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ওই এলাকার মানুষ খাবার পানির জন্য মূলত পুকুর ও টিউবওয়েলের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে।

‘এ ছাড়া কিছু এলাকায় লবণ পানির চিংড়ি চাষের কারণে সুপেয় পানির পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণেও অনেক পুকুর লোনা পানিতে ভরে গেছে। পরে তা সংস্কার করা হয়নি।’

খুলনা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকমল হোসেন বলেন, ‘উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে সুপেয় পানির সংকট সমাধানে আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিদেশি অর্থায়নেও এসব উপজেলায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কাজ করে। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি, যাতে বেশি মানুষকে সুপেয় পানি দেওয়া যায়। সুত্র-নিউজবাংলা

‘এ ছাড়া উপকূলীয় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পানির ট্যাংকি বিতরণ করা হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। যেসব এলাকা কিছুটা উঁচু আছে, সেখানে খনন করা হয়েছে পুকুর।’

বিএ

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর..