রাজশাহীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে। একাধিক খুনের ঘটনাও ঘটেছে। নগরীতে ইভটিজিং, চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আসছে কিশোর গ্যাং চক্র। এতে চরম উৎকণ্ঠায় নগরীর বাসিন্দারা। খোদ পুলিশের আশকারায় কিশোর গ্যাং চক্র অপরাধে জড়িয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আসামির তথ্য দিলেও আটক না করে পুলিশ ‘ব্যস্ততা’ দেখাচ্ছে বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগে কিশোর গ্যাং ধরতে ডাটাবেজ করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি)। সেই ডাটাবেজ অনুযায়ী সন্দেহভাজন কিশোরদের আটক করা হয়। পরে মুচলেকা নিয়ে তাদের অভিভাবকের জিম্মায় দেয় পুলিশ। এছাড়া সিসিটিভি দিয়ে নগরীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অপরাধী শনাক্ত ও আটক করছিল পুলিশ। তবে ৫ আগস্ট দেশজুড়ে উদ্ভুত ঘটনার সময় নগরীর সিএন্ডবি এলাকায় আরএমপি হেডকোয়ার্টারে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে সেই কিশোর গ্যাংয়ের ডাটাবেজ হারিয়ে যায়।
সূত্র জানিয়েছে, নগরীর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, তার মেয়ে আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। এই তিন নেতার মদদে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নগরীর কিশোর গ্যাং চক্রকে দিয়ে অপরাধ করিয়ে নিতেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত রাসিক কাউন্সিলরদের পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গড়ে উঠে কিশোর গ্যাং চক্র। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতাদের অফিসে অস্ত্রভান্ডার তৈরি করা হয়। সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়ায় কিশোররা।
সূত্রমতে, নগরীর ভদ্রা মোড়, সিএন্ডবি, লক্ষিপুর, টিকাপাড়া (খুলিপাড়া), কেদুর মোড়, হোসনিগঞ্জ বেতপট্টি, পাঠানপাড়া, কলাবাগান, অলোকার মোড়, হেতম খা, নিউ মার্কেট, তালাইমারি, বিমান বন্দর সড়ক, গ্রেটার রোড ও সিটি বাইপাসসহ আরও অন্তত ১৫টি পয়েন্টে কিশোর গ্যাং সদস্যরা প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পথচারী ও অটোরিকশাযাত্রীদের থেকে ছিনিয়ে নেন টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র।
তথ্যমতে, গতবছরের জুলাই মাসে নগরীর বনগ্রাম গাংপাড়া এলাকায় হাঁসুয়া, চাপাতি, রামদা, চাইনিজ কুড়াল, চাকু ও ছুরিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নাচানাচি করে কিশোর গ্যাংয়ের একটি গ্রুপ। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ড্রামের বাজনার সঙ্গে সঙ্গে বুনো উল্লাস করছিল তারা। এ নিয়ে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে অবশ্য পুলিশ কয়েকজনকে আটক ও বেশকিছু অস্ত্র উদ্ধার করে।
নগরীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, এলাকাভিত্তিক গড়ে ওঠা বিভিন্ন কিশোর গ্যাং আবারও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশের নজরদারির অভাবে নতুন নতুন গ্রুপও তৈরি হচ্ছে। ছিনতাই ও ছুরিকাঘাত যেন নিত্যদিনের ঘটনা। মোটরসাইকেল নিয়ে হচ্ছে বেশিরভাগ ছিনতাই।
ড্রাইভার সজল উদ্দিন একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। গত ১৯ অক্টোবর বিকেলে তার স্ত্রীর কাছ থেকে স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ও টাকা ছিনতাই করা হয়। পরে তারা থানায় অভিযোগ দেন। সজল দৈনিক জবাবদিহিকে বলেন, আমার স্ত্রী ও ছোটবোন দুই সন্তানকে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট থেকে দাওয়াত খেয়ে আসছিলেন। রেলগেটে বাস থেকে নামার পর রিকশায় ওঠেন। গয়না ও মোবাইল পার্টস ব্যাগে রেখেছিলেন। ভদ্রার অদূরে রেশম অফিসের বিপরীত দিকে ভাঙড়িপট্টির সামনে মোটরসাইকেলে করে দুজন এসে ব্যাগটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। সজলের অভিযোগ, মোবাইল উদ্ধার হওয়ার পর আসামিকে আমি চিহ্নিত করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আলী আকবরকে জানাই। তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে আসামি ধরছেন না, আমার ছিনতাই হওয়া জিনিসও উদ্ধার করছে না।
সূত্র জানিয়েছে, এসআই আলী আকবর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের অলিখিতি ‘বডিগার্ড’ হিসেবে কাজ করেছেন। বিষয়টি আরএমপি কমিশনার জানার পর তার বদলির আদেশ দেন। কিন্তু বদলির আদেশের ২ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনো বোয়ালিয়া থানায় রয়েছেন। এছাড়া ডিবির এএসআই রানা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে এসব অপরাধে জড়িত। পুলিশের পোশাকে অপরাধীদের সঙ্গে সখ্যতা করে অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।
সর্বশেষ বুধবার (২৭ নভেম্বর) একই জায়গায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছেন ট্রান্সপরেন্সি ইন্টারন্যাশন্যাল বাংলাদেশের সদস্য প্রকৌশলী রাবেয়া বারি। তাৎক্ষণিকভাবে বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন তিনি। রাবেয়া বারি দৈনিক জবাবদিহিকে বলেন, ভাঙড়িপট্টির সামনে মোটরইসাইকেলে করে এসে আমার ব্যাগ ছিনতাই করে দুজন ব্যক্তি। ব্যাগে দুটি এন্ড্রয়েড মোবাইল, ব্যাংকের ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড, টাকা ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিল। পরে থানায় অভিযোগ করতে গেলে একটি ফোন কলে জানানো হয়, ব্যাগটি একটি জায়গায় পড়ে আছে। সেখানে গিয়ে ব্যাগ পাই। কিন্তু ফোন, টাকাপয়সা আর পাইনি।
তার স্বামী আরিফুর রহমান দৈনিক জবাবদিহিকে বলেন, একই জায়গায় দুজন কোরিয়ান নাগরিকের মোবাইল ও ল্যাপটপ ছিনতাই করা হয়েছে। রাবেয়া বারি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এসব ঘটনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
এদিকে, নগরীতে খুনের ঘটনাও কম নয়। গত ২৬ অক্টোবর রাত ১০টায় নগরীর পঞ্চবটি এলাকায় মিম (২০) নামে এক যুবকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর এয়ারপোর্ট থানার ভুগরইলে অটোচালক সিরাজুল ইসলাম, ২২ সেপ্টেম্বর দামকুড়া থানায় অটোচালক সাজামুল ইসলাম, ১৭ অক্টোবর কাঁটখালীতে রিকশাচালক আলম নামের তিন ব্যক্তির হত্যার শিকার হন। এছাড়া গত বছর ৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় কচুয়াতৈল এলাকায় পল্লী চিকিৎসক এরশাদ হত্যা এবং একই রাতে বর্ণালী এলাকায় ডা. কাজেম আলীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। ডা. কাজেম খুনের ঘটনায় পুলিশের উচ্চপদস্থ দুই কর্মকর্তা সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ করেছেন চিকিৎসকরা। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হেমাটলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এম মুর্শেদ জামান মিঞা বলেন, আরএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটের প্রধান উৎপল কুমারকে ধরলেই খুনের সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
অভিযোগ রয়েছে, কিশোর গ্যাং চক্রের নেতাদের প্রত্যেকের রয়েছে দেড়-দুই লাখ টাকা দামের আইফোন। দামি দামি গাড়ি প্রায়ই পরিবর্তন করেন তারা। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকায় আইনের আওতায় আসেন না তারা। পুলিশের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিআইজি জানান, পুলিশের স্বভাব পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত অপরাধ কমবে না। রাজশাহী নগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে থানার ওসিদের সখ্যতা রয়েছে। তারা সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়।
নগরীতে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন সচেতন মহল। এ বিষয়ে সুশানের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি আহমেদ শফি উদ্দিন দৈনিক জবাবদিহিকে বলেন, এসব ঘটনা আমরা কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করেছি। এগুলো রীতিমতো আশঙ্কাজনক ও আতঙ্কজনক। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজ- কারোই তেমন ভূমিকা দেখিনি। কিশোরদের নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সময় কাটানোর ব্যবস্থা, ক্রীড়া ও জ্ঞান চর্চাসহ কাজে লাগাতে হবে। পাড়া-মহল্লায় মাঠ থাকবে। শুধু গালিগালাজ করে আইন দিয়ে হবে না, তাদের ভালবাসতে হবে। আর যারা একেবারে বিপথে চলে গেছে, তাদের চিকিৎসা করাতে হবে।
এ ব্যাপারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর মাসুদুর রহমান মুক্তা দৈনিক জবাবদিহিকে বলেন, আরও ভাল অবস্থা প্রত্যাশিত। সেটা আসেনি। অভিভাবকরা সচেতন হলে, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
এসব বিষয়ে আরএমপির বোয়ালিয়া জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) অনির্বান চাকমা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমাদের এডিসি মিডিয়া একজন আছেন, আপনি তার সাথে কথা বলেন।
এ ব্যাপারে আরএমপির মুখপাত্র সাবিনা ইয়াসমিন দৈনিক জবাবদিহিকে বলেন, আমি কাজ শুরু করেছি। ডাটাবেজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা পুরনো তালিকা নিয়ে কাজ করতে পারছি না। তবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আরএমপি কমিশনার আবু সুফিয়ান সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হওয়ায় উদ্বিগ্ন নগরীর সচেতন মহল।
বিএ..